আজ ২৬শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

নাচোলে ভ্যানচালিয়ে ডিগ্রীতে লেখাপড়া করেছে ৪১ বছরের মানিক-দৈনিক বাংলার নিউজ

অলিউল হক ডলার, নাচোল:
ইচ্ছেশক্তিই মানুষকে অদম্য করে তোলে। ইচ্ছে শক্তির জোরেই মানুষ শতবাধার পাহাড় ডিঙিয়ে সামনে এগোয় । জয় করেছে শত প্রতিকুলতাকে পেছনে ফেলে চল্লিশউর্ধ মাঈনদ্দিন মানিকও । দারিদ্র্যতাকে পেছনে ঠেলে ইচ্ছেশক্তিতে বলীয়ান হয়ে এসএসসি ও এইচএসসি’র গন্ডি ডিঙিয়ে ডিগ্রী ২য় বর্ষতে লেখাপড়া করছেন। পেশায় ভ্যানচালক মাঈনুদ্দিন মানুক শুধু নাম নয়, দৃঢ়তার প্রতীক গ্রামবাসীর কাছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বদিকে অবস্থিত নাসিরাবাদ গুচ্ছগ্রাম। এ গ্রামে ৮০’র দশকে হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ সরকারের আমলে সরকারিভাবে তৈরি করে দেয়া আবাসনে ঠাঁই নেন মাঈনুদ্দিনের নানী জোহুরা বেগম। আর তার বাড়িতেই.বাবা আবদুল হামিদ ও মা কাঞ্চন বেগম বসবাস করতেন। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে মাঈনুদ্দিন মানিক বড়। বাবা আনসারের কাজের পাশাপাশি ছোট্র চায়ের দোকান চালাতেন। সামান্য আয় দিয়েই চলত পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট সংসার। টানাপোড়নে ছিল নিত্য দিনের সঙ্গী মাঈনুদ্দিনের পরিবারে।
২৫ বছর আগের কথা। মাঈনুদ্দিন মানিক তখন স্থানীয় একটি মাদ্রাসার ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। বোন তৃতীয় শ্রেনীতে আর ছোট ভাই তখনো স্কুলে যেতে শেখেনি। এ সময় মাঈনুদ্দিনের পরিবারে নেমে আসে শোকের মাতম। সবাইকে অকূলে ভাসিয়ে দিয়ে পরপারে পড়ি দেন বাবা আবদুল হামিদ। চোখেমুখে অন্ধকার দেখেন মাঈনুদ্দিন মানিক। কীভাবে চলবে সংসার, নিজের লেখাপড়ইবা করবে কীভাবে? এরকম হাজারো প্রশ্ন তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। অবশেষে পরিবারের দায়ভার কাঁধে নিয়ে ভ্যানের প্যাডেলে পা রাখেন মাঈনুদ্দিন মানিক । সেই থেকে আজও তার সঙ্গী ভ্যান। দারিদ্র্যতা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আর সে কারণে ভ্যান চালিয়ে তাকে সংসার চালাতে হয়। বছর দু’য়েক আগে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে অটোভ্যানে রূপান্তর করতে হয়েছে তাকে। ভ্যান চালানোর পাশাপাশি লেখাপড়া নিয়মিত চালিয়ে যেতে হয়েছে মাঈনুদ্দিন মানিককে।
ভ্যান চালিয়ে বোনকে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানোর পর বিয়ে দিয়ে দেন। ছোট ভাইকে পড়ানোর ইচ্ছে থাকলেও ভাইয়ের আগ্রহ না থাকায় পঞ্চম শ্রেনীর পর আর এগোয়নি। সেও আয় রোজগার করে এককভাবে বসবাস শুরু করে মাকে নিয়ে। এদিকে ২০ বছর পার হলে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন সে। কিন্ত ক্লান্ত মাঈনুদ্দিন মানিক আবারও স্বপ্ন দেখে লেখাপড়া করার। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে দুই মেয়ের বাবা মাঈনুদ্দিন ২০১৫ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নাচোল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসি প্রোগ্রামে ভর্তি হন। অংশ নেন এসএসসি পরীক্ষায়। ২০১৭ সালে এসএসসিতে জিপিএ ৩.২৫ পেয়ে পাশ করেছেন মাঈনুদ্দিন। পরে এইচএসসিতে ভর্তি সেখানেও জিপিএ ২.৫৫ পেয়ে পাশ করেন ২১ সালে। তবে কষ্টের বিষয় ভর্তি ও ফরমফিলাপ এর টাকা না থাকায় পায়ে চালিত ভ্যানটি বিক্রয় করেন সে । নিজের লেখাপড়ার পাশাপাশি দুই মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করেছেন তিনি। বড় মেয়ে ইয়াসমিন ১০ম শ্রেণীতে ও ছোট মেয়ে মরিয়ম ৮ম শ্রেনীতে পড়ছে । তার আশা, মেয়েরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। মেয়ে দুটিকে ভ্যান চালিয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারবে কি এ প্রশ্ন পিতা হিসেবে তার নিজের কাছে?
মাঈনুদ্দিন মানিককের এ সফলতায় গর্বিত তার এলাকাবাসী। মনের জোর থাকলে কোনো বাধাই বাধা নয়। আর তাই অভাবও মাঈনুদ্দিনকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।
দেরিতে হলেও ইচ্ছে শক্তির কারণেই সে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করতে পেরেছে। মাঈনুদ্দিনের এ চেষ্টায় মুগ্ধ প্রতিবেশী মহিলা আনছার সদস্য জাহানারা বেগম। গ্রামের সংরক্ষিত মহিলা ইউপি সদস্য দেলোয়ারা ও তার স্বামী মো. আবেদ আলী সাধুবাদ জানিয়েছে তাকে। নাচোল উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মশিউর রহমান বাবু বলেন, মানিক ভ্যান চালিয়ে যে ভাবে লেখাপড়া করে এসএসসি ও এইচএসসিপাস করে ডিগ্রীতে লেখা পড়া করছে এটা আমাদের গর্ব। তাকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের জন্য সার্বিক সহযোগীতা প্রদান করা হবে। নাচোল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের (অবসরপ্রাপ্ত) সহকারী শিক্ষক একরামুল হক বলেন, ভ্যান চালিয়ে এসএসসি পাশ করা আমার ছাত্র মইনুদ্দীন মানিক নাচোলের গর্ব ও এটি আমার চোখে দেখা প্রথম দৃষ্টান্ত।

এ ক্যাটাগরীর আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এ ক্যাটাগরীর আরো সংবাদ
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com