আজ ২০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৫ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বিলুপ্ত পথে প্রায় ফরিদপুর জেলার  ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ।

 

শহিদুল ইসলাম
আলফাডাঙ্গা( ফরিদপুর) প্রতিনিধি :

গ্রামে দারুণভাবে ঢুকেছে শীত। প্রায়ই কুয়াশার চাদর মুড়ি দিচ্ছে গ্রাম্য জনপদ। শহরে কড়া নাড়ছে শীতের আগমনী বার্তা।
শীতকাল আসলেই খেজুরের রস-গুড়, পিঠা-পায়েশে মনে পড়ে যায় পল্লী মায়ের কোল। পত্রিকা, ম্যাগাজিন, সাময়িকী, টিভি চ্যানেলের প্রতিবেদনে শোভা পায় গাছির (খেজুরের রস উত্পাদনকর্মী) খেজুর গাছ  কাটা এবং  গাছির  ছবি।
ফুলেল সরিষা ক্ষেত, শাক-সবজি ক্ষেতের মাঝে, মেঠোপথের ধারে, সারি সারি রসের হাড়ি সহ খেজুর গাছের ছবি। গাছির বাকে  করে রস বয়ে নিয়ে যাবার ছবি, তুলতে সবাই ক্ষণিকের জন্য ফটোগ্রাফার হয়ে যায়। রূপসী বাংলার এই ক্যানভাস দেখলে আপাদমস্তক নগর জীবনের বাসিন্দারও মনটা জুড়িয়ে যায়। শৈশব যাদের গ্রামে কেটেছে তাদের মধ্যে খুব কমই আছে যারা অন্যের খেজুর গাছ থেকে রাতে বন্ধুরা মিলে রস চুরি করে  খায়নি।
রস চুরি করাকে কেন্দ্র করে খেজুর গাছের মালিকরাও তেমন আপত্তি তুলত না। এটাই ছিল বাঙালির হাজার বছরের পুরাতন গ্রামীণ সংস্কৃতির উজ্জ্বলতম উদাহরণ। এখন জনপদের এই সব দারুণ দারুণ ব্যাপার হারিয়ে যেতে বসেছে।
এই সমস্ত কর্মকাণ্ডের জায়গায় গ্রাম-শহরে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মাদক হানা দিয়েছে।
যা শেষ করে দিচ্ছে অনেক সম্ভাবনাময় তরুণদেরকে, জাতীয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ ও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সার্বিক উন্নয়ন। এত কিছুর পরও ভোজন বিলাসীদের কাছে অতি প্রিয় খেজুরের রস ও গুড়ের তৈরি পিঠা-পায়েশ। এক সময় গ্রাম-গঞ্জে জামাই, আত্মীয়-স্বজন আপ্যায়নের প্রধান অনুসঙ্গ ছিল খেজুর গুড়ের তৈরি বাহারি সব খাবার-দাবার।

ডাক্তারি ভাষ্য মতে, খেজুরের রস পেটের পরজীবী ধ্বংস করে এবং বিভিন্ন রোগের এন্টি-বায়োটিক হিসেবে কাজ করে। নগরের বার্গার-স্যান্ডউইচসহ ফাস্টফুডের সংস্কৃতিতেও শীতকাল জুড়ে শহরের পথে-ঘাটে খেজুর গুড়ের ভাঁপা পিঠা-পুলিসহ নানা ধরনের খাবার পাওয়া যায়।
তবে পরিতাপের বিষয়, শীতকাল ব্যতিরেকে নবান্নসহ কিছু ঐতিহ্যবাহী উত্সব ও মেলায় খেজুর গুড়ের পিঠা-পায়েশের দেখা মেলে।
যদিও অনেক ক্ষেত্রে পিঠা-পায়েশ তৈরিতে খেজুরের গুড়ের স্থানে চিনির ব্যবহার করা হয়। যা স্বাদে-গন্ধে খেজুরের গুড়ের তৈরি পিঠা-পায়েশের মতো সুস্বাদু নয়।
বৃহত্তর ফরিদপুর  জেলাসহ সারাদেশে খেজুর গাছ উজাড় করে, চাষের জমি বের করে অন্য লাভজনক ফসল চাষাবাদ করা হচ্ছে।
বেআইনি ভাবে অনেক ইটভাটার মালিক প্রাকৃতিক কয়লা ব্যবহার না করে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে খেজুর গাছ। বর্তমান কৃষি অর্থনীতিতে খেজুর গাছকে চাষের বিবেচনায় নিলে, এটা হতে পারে দেশের অর্থনৈতিক চাবিকাঠি।
এ দিকে একটি অসাধুচক্র আখের চিনির সঙ্গে বিভিন্ন কেমিক্যালের মিশ্রণ করে, হুবহু খেজুরের গুড় তৈরি করছে।
যা মানব শরীরের জন্য খুব ক্ষতিকর। নীতি বিবর্জিত মানুষের এহেন অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের কারণে, খেজুর গাছের ঐতিহ্য ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনছে।
তাই গ্রাম বাংলার  ঐতিহ্য বাঁচাতে এবং প্রকৃতির ভারসাম্য রোধ করতে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা খেজুর গাছগুলোকে রক্ষা করতে হবে।
এজন্য সর্বপ্রথম সরকার ও কৃষিবিভাগের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। খেজুর গাছ রক্ষায় পরিবেশবাদী, কৃষিবিদ সহ সচেতন মহলকে সোচ্চার হতে হবে।
এক্ষেত্রে কৃষক ও জনগণকে হতে হবে দায়িত্বশীল। কারণ একজন কৃষক ইচ্ছা করলেই ফসলের কোনো ক্ষতি না করে খুব সহজে জমির আইল বা সীমানায় খেজুর গাছ রাখতে পারে।
বলা প্রয়োজন, দেশি খেজুর বিষয়ে উচ্চতর গবেষণার মাধ্যমে জাত উন্নয়ন সম্ভব হলে মানুষ খেজুর গাছ রক্ষা ও নতুন করে চারা রোপণ করে ব্যবসায়িকভাবে চাষে আগ্রহী হবে। তাতে করে কৃষিখাতে খেজুর বিপ্লবসহ, দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে এবং বাঙালির হাজার বছরের খেজুরের রস-গুড়, পিঠা-পুলি, পায়েশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ফিরে পাবে হারানো মহিমা।
জাতীয় সংসদ ভবনের উত্তর প্লাজার খেজুর বাগান দেখে মনটা ভরে যায়। তেমনই দেশি খেজুরের জাত উন্নয়নের পর দুবাই, সৌদি, কুয়েতের রাস্তাঘাটের মতো এদেশের প্রতিটি মহাসড়ক ও রাস্তায় খেজুর গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়াক, উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ।
আশা করি, বর্তমানে যে সরকার আছে এবং আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তারা কৃষিবান্ধব মানসিকতার পরিচয় দিয়ে খেজুর গাছ সংরক্ষণ করে,বাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখার সুপারিশ করছি।

এ ক্যাটাগরীর আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এ ক্যাটাগরীর আরো সংবাদ
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com